পাচশো বছর আগের সোমালিয়া ছিল সম্পদে পরিপূর্ণ এক দেশ।তখন সোমালিয়া বলে আলাদা কোন দেশ ছিল না,পুরো সোমালিয়ায় মানুষের আবাসও ছিল না।দক্ষিণে,সমুদ্রের তীর ধরে গড়ে উঠেছিল এক শক্তিশালী সালতানাত,নাম দাউলাদি আজুরান।
ভাস্কো দা গামা আফ্রিকার পূর্ব উপকূল ঘেষে ভারতে পাড়ি দেবার সময় লিখে গেছেন মোগাদিসুর সম্পদের কথা।
শহর ভরা বড় বড় চার পাচতলা বাড়ি,প্রচুর গাছে ভরা বাগিচা,সুরম্য মসজিদ,মাদরাসা আর প্রাসাদ।
সোমালিয়াতে তখন আরব-ইরান-মিশরের অনেক সওদাগররা সপরিবারে থাকতো।থাকতো ভারত,ভেনিস,ইন্দোনেশিয়া এমনকি চীন থেকে আসা বণিকের দল।
মোগাদিসু,বারাওয়া,মোম্বাসা আর মারেগ,মার্কা,কেলাফোর মত বন্দরগুলো ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র।
পৃথিবীর সব বড় বড় সাম্রাজ্যের সাথে সোমালিদের ব্যবসা ছিল।মিং চায়নার কাছ থেকে ওরা কিনতো পোর্সেলিন,বেচতো ঘোড়া,হাতির দাত,জিরাফ,জেব্রা আর কুমির।
ভারত থেকে কাপড় আর মসলা কিনতো, বেচতো সোনা,মোম আর কাঠ।ইরানের কাপড় কিনে সোমালিরা বেচতো মিশর,সিরিয়া আর তুরস্কে।
আজুরান সালতানাত ছিল বার্লি,ময়দা,ফল,ঘোড়া,ভেড়া,মোম,কাঠ আর মাংসে পরিপূর্ণ,অত্যন্ত ধনাঢ্য এক সালতানাত।
ওরা শান্তিতেই ছিল,ততদিন পর্যন্ত,যতদিন না এই সম্পদের ওপর ইউরোপিয়ানদের চোখ না পড়লো।
ষোড়শ শতাব্দীর শুরু থেকেই পর্তুগীজরা একে একে লুটে নিতে শুরু করলো সোমালি শহর-বন্দরগুলো।
আজুরান সুলতান প্রথমে জোর প্রতিরোধ চালালেন,কিন্তু বেশিদিন টিকতে পারলেন না।
আর্কবুজ আর কামান বসানো জাহাজ তখন সর্বাধুনিক প্রযুক্তি।
একে একে মোগাদিসু ছাড়া সব বন্দরগুলো চলে গেল পর্তুগীজদের দখলে।
আজুরান সুলতান আমীরুল মুমিনীন সুলেইমানের সাহায্য চাইলেন।
বছরখানেকের মাথায় হাজির হল অটোমান নৌবাহিনী।নতুন প্রযুক্তিতে বানানো জাহাজ,আর্কবুজ,বড় বড় কামানে সজ্জিত আর্টিলারী ব্রিগেড এসে নামলো সোমালিয়ার উপকূলে।
শুরু হল লড়াই।
প্রথম দিকে পর্তুগীজরা জিতলো।
তারা বারাওয়া দখল করে শহর পুড়িয়ে ছাই করে দিল।
আজুরান-অটোমান যৌথ বাহিনীর দুই কমান্ডার এক রক্তশপথ নিলেন,পর্তুগীজ না তাড়িয়ে তারা জাহাজ থেকে নামবেন না।
আট মাস ভয়ানক লড়াইয়ের পর পর্তুগীজরা পিছু হটা শুরু করলো।মোগাদিসুতে তারা ভিড়তেই পারলো না,আর বাকি শহরগুলোর প্রায় সবকটা অটোমানদের সাহায্য পেয়ে দখল করে নিল আজুরানরা।
£££
ওদিকে আবিসিনিয়াতে খ্রিস্টানদের সাথে মুসলিমদের লড়াইয়ের মোড় ঘুরে যায় ভাস্কো দা গামার বড় ছেলে ক্রিস্তাভাওয়ের মৃত্যুর পর।
আহমেদ ইবন ইব্রাহীম আল গাজী তাকে ইসলাম গ্রহনে অস্বীকৃতি জানানোর পর হত্যা করেন,অথচ এই বন্দী রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে হতে পারতো অসাধারন।
ক্ষুদ্ধ অটোমান বাহিনী আবিসিনিয়া ছেড়ে চলে গেলে আহমেদ ভাবতে থাকেন অটোমানদের ট্যাকটিকস তার শেখা হয়ে গেছে,এখন তিনি তাদের ছাড়াই জিততে পারবেন।
বাস্তবে দেখা গেল ঘটনা উলটো।১৫৪৩ সালে ব্যাটল অফ ওয়াইনে দাগায় পর্তুগীজরা চুরমার করে দেয় আবিসিনিয়ার আদাল সাম্রাজ্যের শক্তি।শহীদ হন আহমাদ।
আদাল সালতানাতের একটা বড় অংশ জয় করে নেয় ইথিওপিয়ার সলোমনি সাম্রাজ্য।
তাদের ঠেকাতে ১৫৫০ সালে ইমাম আহমাদের বিধবা স্ত্রী বাতি দেল ওয়াম্বারা হারারের আমির নুর ইবনে মুজাহিদকে বিয়ের প্রস্তাব দেন।
ওয়াম্বারার বয়স তখন চল্লিশ,তবু বিয়ের রাজনৈতিক গুরুত্ব অনুধাবন করে নুর ইবন মুজাহিদ এই প্রস্তাব কবুল করেন।
মামী আর ভাগনের এই অসম বিয়েতে মোহরানা ছিল শুধু জিহাদ।
নুর ইবনে মুজাহিদের আহবানে আবিসিনিয়াতে হাজির হয় অটোমান নৌবহর।
১৫৫৭ সালের দিকে নুরের সাহসী নেতৃত্বে আদালরা ইউরোপিয়ান কলোনিয়াল দস্যুদের হারিয়ে দিয়ে মুসলিম শাসনকে শক্তিশালী করেন।
এরই মধ্যে মালদ্বীপে জ্বলে ওঠে অশান্তির আগুন।
মালদ্বীপের সুলতান হাসসানকে হত্যা করে সেখানকার দখল নিয়ে নেয় পর্তুগীজরা।মুহাম্মাদ থাকুরাবান নামের এক সাহসী মুসলিম যুবক লড়াইয়ে নামেন পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে।
মুহাম্মাদ মাত্র ছয় মাসের ভেতরেই জনসাধারনকে নিয়ে গেরিলা বাহিনী তৈরি করেন,এই বাহিনীর অস্ত্র সরবরাহ আসতো অটোমানদের কাছ থেকে।
ভুমির কাছাকাছি যেখানেই লড়াই হত,জিততো অটোমানরা,কিন্তু গভীর মহাসাগরে পর্তুগীজরা পরিষ্কারভাবে এগিয়ে থাকতো তাদের জাহাজ ডিজাইনিংয়ের জন্য।
গভীর মহাসাগরে ভেসে বেড়াতে ওদের সাহায্য করতো লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা মাংস,এক ব্রেক থ্রু টেকনোলজি।
তাই এত কাঠখড় পুড়িয়েও ভারত মহাসাগরে অটোমানরা আধিপত্য বিস্তার করতে পারে নি।তবে লোহিত সাগর,আরব সাগর আর পূর্ব আফ্রিকা উপকূল তারা নৃশংস পর্তুগীজদের হাত থেকে রক্ষা করেছিল।
মালদ্বীপবাসী আজও রবিউল আউয়াল মামাসের এক তারিখে পর্তুগীজদের
বিপক্ষে জয়ের দিনকে তাদের জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করে।
£££
ওদিকে লড়াই ঘনিয়ে আসছিল ভুমধ্যাসগরেও।
ফ্রান্সিসের মৃত্যু আর চার্লসের ক্ষমতা ত্যাগের পর ফ্রান্স,স্পেন আর জার্মানির রাজনীতি যায় বদলে।
১৫৫৫ সালে অগবার্গ শান্তিচুক্তির ফলে ঠিক করা হয়,জার্মানির রাজ্যগুলোর যেটার রাজা ক্যাথলিক,তার জনগনকে হয় ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহন করতে হবে,নয় যে রাজা প্রোটেস্ট্যান্ট,তার রাজ্যে চলে যেতে হবে।আবার প্রোটেস্ট্যান্ট রাজ্যের ক্যাথলিকরা ক্যাথলিক রাজার কাছে চলে আসতে বাধ্য থাকবে।এই চুক্তির ফলে জার্মানিতে অস্থিরতা হ্রাস পায়।
১৫৫৬ সালে চার্লসের পদত্যাগের পরে তার সাম্রাজ্য ভাগ করে দেয়া হয় তার ভাই আর ছেলের মাঝে।স্পেন,ইতালি ও আফ্রিকা-আমেরিকার কলোনীগুলো দেয়া হয় তার সন্তান ফিলিপকে,আর জার্মানী,হাঙ্গেরী,অস্ট্রিয়া,বোহেমিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার রাজ্যগুলো নিয়ে
নতুন হোলি রোমান এম্পেরর হন চার্লসের ভাই,ফার্দিনান্দ।
ফার্দিনান্দ ছিলেন তার ভাইয়ের চকইতে অনেক বেশি সহিষ্ণু,আর ঠান্ডা মাথার শাসক,তার পরিশ্রমের ফলে জার্মানীতে শান্তি ফিরে আসে।
অন্যদিকে ফিলিপ ছিলেন তার পিতার চাইতেও বেশি এন্টি সেমেটিক।ইহুদী,মরিস্কো মুসলিম আর প্রোটেস্ট্যান্টদের পুড়িয়ে মারাকে তিনি মনে করতেন ঈশ্বরের আরাধনার শামিল।তার এই আগ্রাসী নীতির কারনে নেদারল্যান্ডসে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মগুরু জন ক্যালভিনের অনুসারীরা উইলিয়াম দ্যা অরাঞ্জের নেতৃত্বে পোপ ও ফিলিপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে।তারা তাদের বিদ্রোহ ও পশ্চিম ইউরোপীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের জন্য সুলেইমানের কাছে আবেদন জানায়।ষোড়শ শতকের ইউরোপে ডাচদের জাতীয় স্লোগান ছিল,"Leiver Turks Dan Pappas!!"-অর্থাৎ,তুর্কীদের শাসন মানতে রাজি আছি,তবু পোপকে মানি না।
সুলেইমানের জন্য ফিলিপ আর ফার্দিনান্দের ভেতর হাবসবুর্গগ সাম্রাজ্য ভাগ হয়ে যাওয়া ছিল এক অসুবিধাজনক ব্যাপার।কিন্তু নেদারল্যান্ডসে এই বিদ্রোহ তাকে স্পেনের বিরুদ্ধে নতুন কূটনৈতিক চাল চালার সুযোগ করে দিল।ফ্রান্সের মাধ্যমে সুলেইমান ডাচ বিদ্রোহীদের নিয়মিত অর্থ সহায়তা দেয়া শুরু করলে।
আজকের ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডস তাদের স্বাধীনতার জন্য অনেকটাই ঋণী অটোমানদের,বিশেষ করে সুলতান সুলেইমানের কাছে।
ডাচদের বিদ্রোহে সুলেইমানের এই সাহায্যে যারপরনাই ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন ফিলিপ।
ভূমধ্যসাগর থেকে অটোমানদের উচ্ছেদ করার জন্য আবারও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে স্পেন।
#Suleyman_the_Magnificent
#উসমানীয়া_খিলাফত
#Ottoman_Empire
No comments:
Post a Comment