খালেদা জিয়া একাধিকবারের প্রধানমন্ত্রী। তার ঘোষিত ভিশন ২০৩০ নিয়ে কথা হতেই পারে। কিন্তু অপমানজনক কথাবার্তা বা সমালোচনার নামে নিন্দা ঠিক ভালো লাগছে না। এটা মানি, বেগম জিয়া এখন আর আগের জায়গায় নেই। তার ক্যারিশমা এখন অস্তমিত। বয়স তাকে কাবু করে ফেলেছে। তিনি ভালো করে কথা বলতে পারছেন না। তার হাঁটুর ব্যথা, তার চলাফেরার অসুবিধা এখন প্রকাশ্য। বিএনপি দল হিসেবে এমন বিপদে পড়েনি কখনো। আসলে তাদের এতদিনের ছদ্মবেশ খুলে পড়ার পর বিএনপি এখন এক অচল দল। সরকারে থাকতে অভ্যস্ত দলটি বিরোধী দলে আসার পর ধীরে ধীরে এতটা হীনবল হয়ে যাবে কেউ ভাবেনি। পরপর দুবার আওয়ামী শাসনের পর বিএনপি কাগুজে দলে পরিণত হয়ে যাবে এটা বোধকরি আওয়ামী লীগও কল্পনা করতে পারেনি।
বলা বাহুল্য, শেখ হাসিনার উদ্ভাস ও তার নেতৃত্বের বিজয়েই তাদের এই হাল। বঙ্গবন্ধু কন্যা নিজের প্রজ্ঞা আর মেধায় আজ প্রায় অপ্রতিদ্ব›দ্বী। তিনি হঠাৎ করে উঠে আসেননি। তার রক্তে আছে রাজনীতির গৌরবময় উত্তরাধিকার। জীবনের শুরু থেকেই তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি ও দেশের রাজনৈতিক দলের কাজকর্ম দেখে বড় হয়েছেন। তা ছাড়া তার দলের ইতিহাস ও অতীত শুধু দেশ নয়, উপমহাদেশের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। এই দল দেশ স্বাধীন করেছে। এই দলের নেতারা মাঠে-ময়দানে লড়াই করে নেতা হয়েছিলেন। তারা কারাগারে জান দিলেও মত বদলায়নি। বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়ার রাজনীতিকে মানেননি তারা। জিয়াউর রহমানের সময়কাল আর এখনকার সময় কি এক?
তখন শিশু জাতি নাবালক জাতি ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি কি করা উচিত। মাথার ওপর চেপে বসা রাজাকার আর স্বাধীনতাবিরোধীদের তারা মানতে না চাইলেও ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। ক্রমে ক্রমে এরা এমনভাবে জাঁকিয়ে বসেছিল যেন এই আমাদের নিয়তি। অথচ সময় চুপ করে তার কাজ করে যাচ্ছিল। জাতি হয়ে উঠছিল সাবালক। আজ যে প্রজন্ম তরুণ আজ যারা মধ্য বয়সের দ্বারপ্রান্তে তাদের মনে বাংলাদেশ এক জাগ্রত সত্তা। নিজের দেশ বলতে তারা একেই জানে। আমরা যারা পাকিস্তানে জন্মেছি রক্তে যাদের পরাধীনতা তারা এক জীবনে দুই দেশের নাগরিক বা দুই চেহারা দেখে বড় হয়েছি, আমরাই দোদুল্যমান প্রজন্ম। যত দিন আমরা দেশের রাজনীতিতে চলমান ছিলাম আমাদের অগ্রজেরা এর দেখভাল করত তত দিন বিএনপির রমরমা ছিল। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ বিএনপি না জামায়াত না মুক্তিযুদ্ধ। না উদার না মৌলবাদ। না সামরিক না বেসামরিক। এই জগাখিচুড়ির সঙ্গে হুবহু মিলে যায় মুসলিম লীগের রাজনীতি। সে খোলস যখন খুলে গেছে তখন প্রান্তিক নামে পরিচিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভেতর জনপ্রিয় হলেও আসলে বিএনপি মধ্যবিত্তের মনে আর আগের মতো নেই। সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত শ্রেণি বরাবরই এমন। তারা তাদের হক কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিতে জানে।
কি চায় তারা? নিজেদের সুখ বিলাস নিরাপত্তা আর বিনোদন। তার কমতি নেই দেশে। সামাজিক মিডিয়ার নামে যেসব মিডিয়া এখন চলমান তাদের দিকে তাকালেই বোঝা সম্ভব বাংলাদেশ আর যাই হোক পাকিস্তান হবে না। আমাদের মিডিয়াও এ বিষয়ে এতটাই আগুয়ান যে কোনো কিছু এখন আর গোপন থাকে না। যত গোপনীয়তা কমেছে বিএনপির রাজনীতি ততই কোণঠাসা হয়ে গেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শাস্তি আর তাদের পরিণতি নিয়ে টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করতে পারেনি বিএনপি। কেন? কারণ মিডিয়া সব খোলাসা করে দিয়েছে। চুপ থেকে নীরবতার ভেতর দিয়ে সময় পার করা গেলেও নিজেদের আসন ঠিক রাখতে পারেনি বিএনপি। তারা তাদের মিত্রদের প্রতি যেমন অন্যায় করেছে তেমনি এ দেশের জনগণের সঙ্গেও প্রতারণা করেছে। এখন আর কেউ বিএনপিকে ভরসা করে জোট বাঁধবে কিভাবে। যারা তাদের শরিক দলের প্রধানের ফাঁসিতে নীরব থাকে একটা মিছিল পর্যন্ত করতে পাওে না তাদের সঙ্গে জোট বেঁধে কি লাভ অন্যদের?
ফিরে আসি বর্তমানে। বিএনপি হয়তো ভাবছে তারা সরকারে যেতে পারবে এবং গেলে ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু এই ভিশনও গোলমেলে। যেসব আদর্শ উদ্দেশ্য বা কাজের কথা তারা বলছেন সেগুলো ইতোমধ্যে অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। কিছু আছে চলমান। যেগুলো করবে বলে বলা হয়েছে সেগুলো আসলেই অসম্ভব। আবেগের আতিশয্যে জনপ্রতি একজন করে ডাক্তার দেয়ার প্রত্যয় কি বাস্তবোচিত? দুনিয়ার কোন সভ্য দেশে কোন উন্নত দেশে তা হয়েছে? না হতে পারে? এমন আরো অনেক বিষয় আছে যেগুলো মূলত কথার কথা। তারপরও বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। তাদের অধিকার আছে নিজেদের কথা বলার। সেটা কতটা সম্ভব বা অসম্ভব সেটা জনগণই বিবেচনা করবে। তাই বলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিডিয়ায় এসে সব নাকচ করে দিয়ে তাদের মনগড়া কথা বলবেন এটা মানা যায় না।
এতে প্রমাণিত হয় আওয়ামী লীগ আসলে বিএনপিকে তাদের মূল প্রতিদ্ব›দ্বী মনে করে। বিএনপির বাইরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যেসব রাজনৈতিক দলের ঐক্য বা বিরোধ কই তাদের নিয়ে তো তারা কিছু বলে না। এই কদিন আগে এরশাদ সাহেব নতুন জোটের ঘোষণা করলেন। অর্ধশতাধিক সাইনবোর্ড সর্বস্ব দলের সমন্বয়ে এরশাদের জোট কি তাহলে ভুয়া? সেখানে ইসলামী দলেরও লম্বা তালিকা আছে। বহুরূপী এরশাদ কখন কি করেন বলা মুশকিল। হয়তো সে কারণে অথবা বাজার বুঝে আওয়ামী লীগ বিএনপিকেই টার্গেট করেছে। কিন্তু এভাবে বলার ভেতর নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ না করাই দলের জন্য মঙ্গলজনক।
বিএনপি ভিশন প্রকাশ করেছে বটে সে এজেন্ডাগুলোর বাস্তবায়ন অত সহজ না। খালেদা জিয়া ২০৩০ সালে কত বছরে পা রাখবেন? তিনি কি সে সময় এমন সচল থাকতে পারবেন? আর যদি তিনি না পারেন তো বিকল্প কোথায়? তারেক জিয়া একজন দাগি আসামি। আইন তাকে ছাড়বে? তা ছাড়া বিএনপির ঘর গোছাতেই লাগবে দীর্ঘ সময়। সে সময়কালে তাদের পুরনো নেতারা থাকবেন কিনা সেটাও ভাবার ব্যাপার। কথায় বলে গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। সেই কাঁঠাল গাছে ধরতে না ধরতেই তা নিয়ে আওয়ামী তথা সরকারি দলের এই হৈ চৈ মূলত বিএনপিকেই লাভবান করছে। লাভ এইটুকু এখন অন্তত দলগুলো ইশতেহার নামের কাগজের পরিবর্তে কাজের তালিকা করে ভিশনের কথা বলছে। আবারো বলি শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের পরিশ্রমী মেধাবী মানুষরাই এর জন্য ধন্যবাদ পাবেন। তারা দেশকে এমন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছেন যাতে বিএনপির মতো দলও ভিশনের পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশ তুমি পারোও বটে।
No comments:
Post a Comment